হিমু হচ্ছে হুমায়ুন আহম্মেদ এর সৃষ্ট একজন জনপ্রিয় কাল্পনিক চরিত্র। তবে এই হিমু এতটাই পাঠক পরিচিত যে হিমু যে একটা কাল্পনিক চরিত্র এটা অনেকেই মানতে চায় না। ইভেন আমি নিজেও এটা অনেকদিন’ই মানতে পারিনি হিমু একজন কাল্পনিক চরিত্র, বাস্তবে এর কোনো এক্সিসটেন্স নেই। কোনো কোনো হিমুভক্ত পাঠক নিজেকে হিমু বলে দাবি করেন। হিমুর পাগল বাবার ধারনা ছিল যদি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার স্কুল কলেজে তৈরী করা যায় তাহলে মহাপুরুষও তৈরী করা যাবে। তিনি একটি প্রশিক্ষণ স্কুল শুরু করেন, মহাপুরুষ তৈরীর স্কুল। তার সেই প্রশিক্ষণের এক এবং একমাত্র গিনিপিগ হচ্ছে হিমু।

ছবি কৃতিত্বঃ আমি হিমু বলছি ফেসবুক পেইজ
কে এই হিমু?
হিমু পথে পথে খালি পায়ে হেঁটে চলে। প্রচন্ড রোদ, শীত, বর্ষা কোনো কিছুই হিমু কে আটকাতে পারেনা। মাঝে মাঝে জোৎস্না দেখার জন্য সে পূর্নিমা’র জন্য অপেক্ষা করে। ঘর সংসার এর প্রতি তার কোনো আকর্ষন নেই। এমনকি তার সুন্দরী বান্ধবী রূপার প্রতি ও তার তেমন কোনো আগ্রহ নেই। যদিও সে জানে রূপা তাকে পাগলের মতো ভালবাসে। হিমুর এই বেখেয়ালী ছন্নছাড়া জীবন-যাপনের কারণ কি? তার জীবনের উদ্দেশ্য আসলে কি মহাপুরুষ হওয়া? কিন্তু তাকে এই সার্টিফিকেট টাই বা আসলে কে দিবে? আমার জানা নেই! হয়ত হিমুরও জানা নেই। তবুও সে হেঁটে চলছে খালি পায়ে, তীব্র শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষায়।
হিমু হাটছে কেন? মহাপুরুষ হতে? আমার তো তা মনে হয় না। সে হেঁটে যাচ্ছে উদ্ভ্রান্তের মত মধ্যদুপুরের রোদে কিংবা নীল জোছনার ভীষণ আকর্ষণে। হিমু কিন্তু এতটাও বোকা না। সে অনেক ভালভাবেই জানে যে মহাপুরুষ সাধনায় হয় না, মানুষের ভিতরেই থাকে। প্রত্যেকটা মানুষই এক একজন মহাপুরুষ, স্পেশাল ভাবে হতে হয় না কাউকে। তবুও সে ছুটে যাচ্ছে কারণ সে চায় না আমাদের জীবনের এই চক্রে সে নিঃশ্বেস হতে। হিমু চায় তার জীবনের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তার কাছেই থাকবে। ইচ্ছে হলে সে হাঁটবো, ইচ্ছে হলে হারিয়ে যাবো। সে কারো ধার ধারেনা। সে কারো কাছে আটকে নেই। হিমু সম্পূর্ণ মুক্ত।
আমাদের জীবন আবদ্ধ। আমরা পরিবার, চাকরী, সমাজ, আত্মীয়-স্বজন, কাছের মানুষদের মায়ার কাছে আটকে আছি। আমরা চাইলেই একদিন অফিস মিস করে ঘুমাতে পারি না। চাইলেই পরিবারের প্রতি দায়িত্ব এড়িয়ে চলতে পারি না। আমদের প্রত্যেকের ভিতরে যে সত্বা থাকে, সেও জানে যে সে পারবে না। তবুও সে হারিয়ে যেতে চায়, খাচা ভেঙে পালিয়ে যেতে চায় অজানায়। কিন্তু পারেনা।
আমি মনে করি হিমু’ই হচ্ছে হারিয়ে যেতে চাওয়া মানুষগুলোর মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ওই সত্তাটা। যে জীবন-সংসারের সব মায়ার টানের ধার ধারেনা। আমার মনে হয় হিমু ইন্ডিভিজুয়াল কোন মানুষ না। হিমু আমাদের প্রত্যেকটা মানুষের হারিয়ে যেতে চাওয়ার সেই আকাঙ্ক্ষা। লেখক হয়তো এটাই বুঝাতে চেয়েছেন, বলতে চেয়েছেন যে জীবনটা অনেক সহজ সরল। আমরা একে গুবলেট করে ফেলি আমাদের ম্যাটারিয়ালসের অবসেশানে। কে জানে!
হিমু পরিচিতি বা হিমুর পরিচয়
যদিও হিমু একজন কাল্পনিক চরিত্র, তারপরও হিমু কে একজন সতন্ত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভাবতেছি একটু পরিষ্কার ভাবেই হিমুর সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেই। চলুন নিচের টেবিলটা দেখে নেওয়া যাক।
ক্রমিক নং | বিষয় | বিস্তারিত |
০১ | ডাক নাম | হিমু |
০২ | পূর্ণ নাম | চৌধুরী ইমতিয়াজ, হিমালয় |
০৩ | বয়স | ২৫ থেকে ২৮ বছর এর মাঝামাঝি |
০৪ | পড়ালেখা | ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়েছে এমন বলা হয়েছে। পাশ করেছে কিনা তা উল্লেখ করা হয়নি |
০৫ | বৈবাহিক অবস্থা | অবিবাহিত |
০৬ | পেশা | বেকার |
০৭ | লিঙ্গ | পুরুষ |
০৮ | বসবাস | কোনো নিদ্রিষ্ট জায়গা নেই। হিমু মাঝে মাঝেই হারিয়ে যায় |
হিমুর নামকরণ
হুমায়ুন আহমেদ সৃষ্ট এই চরিত্র অনুসারে হিমুর আসল নাম হিমালয়। । হিমু যখন ছোট ছিল তখন তার বাবা তার নাম রেখেছিলেন হিমালয়, যা হিমালয় পর্বতের ন্যায় মহত্ব প্রকাশ করে। হিমুর বাবা চেয়েছিলেন তাকে মহাপুরুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। তাই তিনি তার ছেলের এমন নাম রেখেছিলেন। হিমুর পিতামহ হিমুর নাম দিয়েছিলেন চৌধুরী ইমতিয়াজ। ছাত্র জীবনে হিমালয় বা হিমু নাম নিয়ে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হলেও হিমু এই নামটি’ই গ্রহন করে।
হিমুর উল্লেখযোগ্য উক্তিসমূহ
হিমুর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিখ্যাত উক্তিঃ
“নিজের মস্তিষ্কের উপর মানুষের যে পূর্ন নিয়ন্ত্রণ নেই তা মানুষ জানে, কিন্তু স্বীকার করে না।”
“সব মানুষের অন্তত একবার করে হলেও জীবন গোড়া থেকে শুরু করার সুযোগ থাকলে ভাল হত । বড় ধরনের ভুলগুলোর একটি অন্তত শোধরানো যেত।”
“মানুষ সবচেয়ে বড় ভুল করে তখনই, যখন সে কারো প্রতি অসম্ভব ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।”
“কাউকে ভালোবাসার জন্য একটা শক্তিশালী হৃদয়ের প্রয়োজন। আর কারো দ্বারা আঘাত পাওয়ার পরও তাকে ভালোবেসে যাওয়ার জন্য লাগে তার চেয়েও শক্তিশালী হৃদয়। যা অনেকের থাকে না।”
“যে অন্যকে কষ্ট দিতে পারে না, সে নিজেই বেশী কষ্ট পায়।”
হিমু সংক্রান্ত বইমূহ
হিমু চরিত্রের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ময়ূরাক্ষী (১৯৯০) উপন্যাস দিয়ে। অনন্যা প্রকাশনী থেকে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর হিমু চরিত্র তরুণ সাহিত্যপ্রেমীদের মাঝে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। হিমু চরিত্র কেন্দ্রিক সর্বমোট ২৫ টি বই প্রকাশিত হয়।
ক্রমিক নং | বইয়ের নাম | প্রকাশকাল | পৃষ্টা সংখ্যা |
০১ | ময়ূরাক্ষী | মে ১৯৯০ | ৭০ |
০২ | দরজার ওপাশে | মে ১৯৯২ | ১১২ |
০৩ | হিমু | ফেব্রুয়ারি১৯৯৩ | ৭৪ |
০৪ | পারাপার | ১৯৯৪ | ৭৫ |
০৫ | এবং হিমু… | ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫ | ৭৪ |
০৬ | হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম | এপ্রিল ১৪, ১৯৯৬ | ১০৭ |
০৭ | হিমুর দ্বিতীয় প্রহর | ১৯৯৭ | ১২৭ |
০৮ | হিমুর রূপালী রাত্রি | ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ | ৬১ |
০৯ | একজন হিমু কয়েকটি ঝিঁ ঝিঁ পোকা | মে ১৯৯৯ | ১০০ |
১০ | তোমাদের এই নগরে | ২০০০ | ৯৩ |
১১ | চলে যায় বসন্তের দিন | ২০০২ | ১০৪ |
১২ | সে আসে ধীরে | ফেব্রুয়ারি ২০০৩ | ৮৩ |
১৩ | আঙ্গুল কাটা জগলু | ফেব্রুয়ারি ২০০৫ | ১০৭ |
১৪ | হলুদ হিমু কালো র্যাব | ফেব্রুয়ারি ২০০৬ | ৯৫ |
১৫ | আজ হিমুর বিয়ে | ফেব্রুয়ারি ২০০৭ | ৯৫ |
১৬ | হিমু রিমান্ডে | ফেব্রুয়ারি ২০০৮ | ৮৮ |
১৭ | হিমুর মধ্যদুপুর | ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০০৯ | ৯৪ |
১৮ | হিমুর নীল জোছনা | ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১০ | ৮০ |
১৯ | হিমুর আছে জল | ফেব্রুয়ারি ২০১১ | ৮০ |
২০ | হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী | ফেব্রুয়ারি ২০১১ | ৯৮ |
২১ | হিমু এবং হার্ভার্ড পিএইচডি বল্টু ভাই | অগাস্ট ২০১১ | ৯২ |
২২ | হিমু মামা | ফেব্রুয়ারি ২০০৪ | ৮০ |
২৩ | হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য | ফেব্রুয়ারি ২০০৮ | ৯৬ |
২৪ | হিমুর বাবার কথামালা | ফেব্রুয়ারি ২০০৯ | ৪৬ |
২৫ | ময়ূরাক্ষীর তীরে | ২০০০ | ২৮ |
হিমু মহাপুরুষ না হলেও মাঝে মাঝে তার করা ভবিষ্যতবাণী প্রায় ক্ষেত্রেই মিলে যায়। সে কাজ করে যুক্তি-বিরোধী মতানুসারে এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করা’ই হচ্ছে তার প্রধান সখ। প্রায় সময়ই হিমুকে পরোপকার করতে দেখা যায়। কিন্তু তার পরোপোকারও হয় বিভ্রান্তি মিশ্রিত। সর্বোপরি হিমু আমার একটি প্রিয় কাল্পনিক চরিত্র।
Comments